ওয়েব ডেস্ক: ২০১১ সালের পর থেকে বামেদের ভোটে ব্যাঙ্কে যেমন টান পরেছে, তেমনি ধীরে ধীরে কমেছে তাদের সক্রিয় পার্টি কর্মীর সংখ্যা। তাই বিরোধী পরিসরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বামেরা। তেমনি ভোটে তৃণমূলের লাগাতার সাফল্যের পাশাপাশি রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে গত কয়েক বছরে উঠে এসেছে বিজেপি। এ বার দলের সাংগঠনিক পর্যালোচনা রিপোর্টে সিপিএম তা শিকার করে নিয়েছেন, বিরোধী শক্তি হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে তাদের দুর্বলতা রয়েছে বিপুল। এর তারই কারণ দলে উন্নত চিন্তাধারার সক্রিয় কর্মীর অভাব।
শুধু ভোটে লড়াই করে সরকারে গিয়ে ক্ষমতা ভোগে বিশ্বাসী নয় কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের লড়াই সমাজ বদলের। ভোটে লাগাতার ভরাডুবির পরে রাজ্য সিপিএমের সাংগঠনিক ময়না তদন্তে উঠে এসেছে একাধিক দুর্বলতার কথা। বিরোধী দল হিসেবে উপযুক্ত আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়নি। দলের মধ্যে রয়ে গিয়েছে ‘নিষ্ক্রিয়তা’র প্রবল সমস্যা।
দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির উপস্থিতিতে সিপিএমের রাজ্য কমিটির বৈঠকে এক দিকে যেমন সম্মেলনের জন্য রূপরেখা ঠিক করে দিয়ে নোট তৈরি করা হয়েছে, তার সাথে সাংগঠনিক অবস্থার ময়না তদন্ত করা হয়েছে। সেই পর্যালোচনা রিপোর্টেই বলা হয়েছে সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর ত্রুটির কথা। আন্দোলনের বিষয় নির্বাচনে দুর্বলতার জন্য দায়ী করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বকেই। সেখানে আরও বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট নেতৃত্ব কে নিচু স্তরে আরও সময় দেওয়ার কথা।
রাজ্য কমিটির সাংগঠনিক পর্যালোচনা রিপোর্টে বলা হয়েছে: ‘অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, বিগত ১০ বছর আমরা রাজ্যের সরকারে নেই। অথচ আমাদের চলার আগেকার পদ্ধতি বহু ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত হয়নি। বিরোধী দল হিসাবে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক মহল্লা ও বস্তি, খেতমজুর-দিনমজুর এলাকা, মধ্যবিত্ত প্রধান এলাকা— এই ভাবে প্রতিটি এলাকার নির্দিষ্ট সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার দক্ষতা সংশ্লিষ্ট পার্টি নেতৃত্বকে অর্জন করতে হবে’। দলিত, জনজাতি, পিছিয়ে পড়া এলাকার সমস্যাগুলিও চিহ্নিত করা এবং জনতার আলাদা অংশের দাবি বেছে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য গণ-ফ্রন্টগুলিকে বিশেষ দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে।
করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করল নীতি আয়োগ, আক্রান্তর সংখ্যা হতে পারে ৪ লক্ষ
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: ‘এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, রাজ্যে পার্টি সদস্যদের এক বড় অংশের চেতনার মান নিম্ন। সদ্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পার্টি সদস্য, যারা বুথ এলাকায় বসবাসকারী, সে ভাবে নির্বাচনী সংগ্রামে অংশ নিলেন না। বাসস্থান এলাকা, কর্মস্থলে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, রাজনৈতিক বক্তব্য মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর দুর্বলতা রয়ে যাচ্ছে’। বিপর্যয়ের কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে সিপিএমের উপলব্ধি, কোথায় কোন কথা কি ভাবে প্রচার করতে হবে, কি ভাবে আন্দোলন দানা বাঁধানো যাবে— এ সবই সিলেবাস তৈরি করে হয় না। ভাবনা ও চেতনা ঠিক নেই বলে এই ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ব্যর্থ হচ্ছেন, কর্মী বা সদস্যেরাও ভুল পথে চালিত হচ্ছেন।
দলে ‘নিষ্ক্রিয়তার ব্যাধি’ কাটানোর সঙ্গে সদস্যদের ‘গুণগত মানোন্নয়ন’ ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলেই এই রিপোর্টে উল্লেখ করেছে সিপিএম। সেই সঙ্গেই বলা হয়েছে: ‘সমকালীন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার হিম্মত ব্যতিরেকে নেতৃত্ব হয় না! নিজের এলাকাকে ভাল করে জানা, জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের সকলের রয়েছে, অভিজ্ঞতা তা বলছে না’। নেতৃত্বে পরিবর্তনের জন্য বয়স-সীমা বেঁধে দিয়ে এ বার তরুণত্ব অংশকে তুলে আনার উপরে জোর দিচ্ছে সিপিএম। কিন্তু সেখানেও রয়েছে সাবধান-বার্তা। রিপোর্টের ভাষায়, ‘শুধু তরুণদের কমিটির সদস্য বা নেতৃত্বে নিয়ে আসাই যথেষ্ট নয়। সঠিক কর্মী নীতির সাহায্যে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে উন্নত কমিউনিস্ট কর্মী গড়ে তোলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার দাবি করছে’।
ত্রিপুরায় তৃণমূলের ভূয়সী প্রশংসা করলেন বাম নেতা মানিক সরকার
দলের তথ্য বলছে, গত বছরে ৩৭৯ জন প্রার্থী-সদস্যের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদের আবেদন খারিজ হয়েছে। রাজ্যে বর্তমানে দলের সর্বক্ষণের কর্মী সংখ্যা এখন ১৪৯৯। যা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের আক্ষেপ, ‘‘বামফ্রন্ট ভাবতেই পারেনি, ১৯৭৭ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে সরকার হবে! বিরোধী পক্ষ হিসেবে আন্দোলনে বামেদের ভূমিকা দেখেই মানুষ আস্থা রেখেছিলেন। অথচ এখন বিরোধী আসনে যাওয়ার এত দিন পরেও আন্দোলনের দুর্বলতা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে!’’