কখনও IAS এবার কখনও পুরসভার যুগ্ম কমিশনার! একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ দেবাঞ্জন

by Chhanda Basak

ওয়েব ডেস্ক: কসবার ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবকে তদন্তকারীরা যত জেরা করছেন উঠে আসছে একের পর এক কাণ্ড। গত ২২ জুন মঙ্গলবার কসবা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল দেবাঞ্জন দেবকে। সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, কোনও অনুমতি ছাড়া পুরসভার নাম ভাঙিয়ে করোনার টিকা-শিবির করছেন তিনি। কিন্তু বুধবার থেকে পুরোদমে যখন তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে ততই তাঁর বিরুদ্ধে উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। তদন্তের হাত ধরে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে সে তালিকা।

কখনও ias এবার কখনও পুরসভার যুগ্ম কমিশনার! একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ দেবাঞ্জন

উনত্রিশ বছর বয়সী দেবঞ্জন দেব একজন IAS অফিসার এবং কমপক্ষে এক বছরের জন্য তিনি কলকাতা পূর কর্পোরেশনের (কেএমসি) যুগ্ম কমিশনার পদে নিযুক্ত হয়েছেন। দুর্গাপূজার সময় দরিদ্রদের মাঝে কাপড় বিতরণ করা এবং ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সভাপতিকে COVID-19 প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করেন। COVID-19 মহামারী চলাকালীন সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। হঠাৎ কি হল।

ঘটনার সূত্রপাত গত মঙ্গলবার কসবা থানায় খবর যায়, কসবা নিউমার্কেটের পাশে একটি ফ্ল্যাটে ভুয়ো টিকাকরণ শিবির চলছে। এই শিবিরে কোনও সরকারি অনুমোদন নেই। অভিযোগ করেন সাংসদ মিমি চক্রবর্তী, তিনিও সেই শিবিরে গিয়ে টিকা নিয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ দেবাঞ্জন দেব নামে এক ব্যক্তির খোঁজ পান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধরেও নিয়ে যায় পুলিশ। বুধবার গ্রেফতার করা হয় তাকে। একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করেছে কসবা পুলিশের কাছে।

অভিযোগ ১: ভুয়ো টিকাকরণ শিবিরের আয়োজন

জলের সঙ্গে পাউডারের গুঁড়ো মিশিয়ে টিকা বানিয়ে সেই টিকা করোনার প্রতিষেধক বলে শতাধিক মানুষের শরীরে দিয়েছেন দেবাঞ্জন ও তার টিম। নিজেকে IAS পরিচয় দিয়ে সাংসদ মিমি চক্রবর্তীর দফতরেও ফোন করেছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন টিকা নিতে। মিমি তাতে সাড়া দিয়ে টিকা নিয়েও এসেছেন। কসবার পাশাপাশি আমহার্স্ট স্ট্রিটেও একটি টিকাকরণ শিবির করেছিলেন দেবাঞ্জন। সেখানেও বহু মানুষ এই টিকা নেন। অধিকাংশকেই বলেছিলেন কোভিশিল্ড দিচ্ছেন। কারও কারও কাছে দর বাড়াতে নাকি স্পুটনিক ভি’র কথাও শোনান। শুধু ভুয়ো ভ্যাকসিনই নয় ভুয়ো স্যানিটাইজারও বিলি করেছেন। তাঁর অফিস থেকে উদ্ধার হওয়া স্যানিটাইজারের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাতে ইথাইল অ্যালকোহল নেই, রয়েছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। যা ঘরবাড়ির জীবাণুনাশে ব্যবহার করা হয়।

অভিযোগ ২: কলকাতা পুরসভাই তুরুপের তাস

দেবাঞ্জন দেবের বিরুদ্ধে যে সমস্ত জালিয়াতির অভিযোগ, তার বেশিরভাগই কলকাতা পুরসভাকে জড়িয়ে। অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার ডেপুটি ম্যানেজারের নামে ফেক ইমেল আইডি খুলেছিল দেবাঞ্জন। বিশেষ কমিশনারের সই জাল করে বেসরকারি ব্যাঙ্কে কলকাতা পুরসভার নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন তিনি। এরকম আটটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে। কলকাতা পুরসভার সাথে সমান্তরাল একটি অফিস কসবাতে খুলে বসেছিলেন তিনি। পুরসভার স্ট্যাম্প ব্যবহার করে ভুয়ো নিয়োগপত্র দিয়ে কর্মী নিয়োগ করেছিলেন। মাসিক বেতন ২৩ হাজার টাকার চুক্তিতে ‘নিয়োগ’ করেছিলেন পুরসভার ‘হেড ক্লার্ক’। পুরসভার নাম ভাঙিয়ে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাকে ১৭১টি টিকা বিক্রিও করেন দেবাঞ্জন।

করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কেন জর আশে, কারণ জানালেন বিশেষজ্ঞরা

অভিযোগ ৩: স্মার্ট ক্লাসের জন্য ২০টি স্কুল বেছে নেন

২০টি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে স্মার্ট ক্লাসের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন দেবাঞ্জন। স্পোর্টস অ্যাকাডেমির পাশাপাশি দেবাঞ্জনের স্মার্ট অনলাইন ক্লাস তৈরি করারও একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। বেহালার একটি কোম্পানির কাছ থেকে প্রায় ১২ লক্ষ টাকার সামগ্রী কিনেছিলেন। যার মধ্যে ১০ লক্ষ টাকার প্রতারণা করেছিলেন।

অভিযোগ ৪: সরকারি আধিকারিক পরিচয় দিয়ে টাকা আত্মসাৎ

ট্যাংরার এক ব্যবসায়ীর দাবি, তাঁর কাছ থেকে কমিউনিটি হল তৈরির নামে দেবাঞ্জন ৯০ লক্ষ টাকা নেন। একটি বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগও দায়ের হয়েছে। যে টাকার বিনিময়ে ওই সংস্থার ১৭২ জন কর্মীকে টিকা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এক ফার্মা কোম্পানিকে টেন্ডার পাওয়ানোর নাম করে ৪ লক্ষ টাকা নেওয়ারও অভিযোগ দায়ের হয়েছে দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ৫: ফিনান্স কর্পোরেশন থেকে বেতন দিতেন কর্মীদের

ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিনকর্প একটি সরকারি নিগম। সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়া হয় এখান থেকে। দেবাঞ্জনের কসবার অফিসের কর্মীরা ২৫-৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। সেই কর্মীদের অ্যাকাউন্টে বেতনের টাকা ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিনকর্প থেকে ক্রেডিট হয়েছে। যা দেখে তাজ্জব গোয়েন্দারাও।

অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর, জেনেনিন প্রোটিনের সঠিক মাত্রা

অভিযোগ ৬: কারও কাছে আইএএস, কারও কাছে পুরসভার পদস্থ কর্তা

কলকাতা পুরসভার যুগ্ম কমিশনার পরিচয় দিয়ে জালিয়াতির জাল বুনেছিলেন দেবাঞ্জন। পুর কমিশনারের সই জাল করে তৈরি করেছিলেন ভুয়ো আইডি কার্ড। পুরসভার নাম করে কসবায় একটি এনজিও চালাতেন। পুরসভার বিশেষ কমিশনারের সই জাল করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। অ্যাকাউন্ট খুলতে পুরসভার নথি, রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করেন। অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন পুরসভার জিএসটি নম্বর। কলকাতা পুরসভার হলোগ্রাম ব্যবহারেরও অভিযোগ উঠেছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুরসভার লোগো দেওয়া মাস্ক, স্যানিটাইজার বিলি করতেন। পুরসভার জাল ব্যানার, হোর্ডিং বানিয়ে তিলজলায় ‘দুয়ারে সরকার’ আয়োজন করেন। পুরসভার নাম করে সোনারপুর এবং উত্তর কলকাতায় ত্রাণও বিলি করেন।

অভিযোগ ৭: নিজেই তৈরি করেন টিকার লেবেল

দেবাঞ্জনের অফিসের কম্পিউটারে মিলেছে নকল কোভিশিল্ড-এর লেবেল তৈরির গ্রাফিক্স। অর্থাৎ তার কম্পিউটারেই লেবেল ছাপানোর গ্রাফিক্স তৈরি করা হয়েছিল। তারপর তা বাইরে থেকে ছাপিয়ে এনে প্রত্যেকটি ইনজেকশনের শিশিরের ওপর সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেবাঞ্জনের অফিসের কম্পিউটার হার্ডডিস্ক বাজেয়াপ্ত করেছেন গোয়েন্দারা। ভারতে এখনও অনুমোদনই মেলেনি যার, সেই ফাইজ়ারের ‘টিকা’ দেবাঞ্জনের অফিস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

অপারেশন “ভুয়ো টিকাকরণ” এর সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল জানালেন ভুয়ো IAS দেবাঞ্জন দেব

অভিযোগ ৮: গৃহশিক্ষককেও প্রতারণার জালে বেঁধেছিলেন

বিএসসি পড়ার সময় জুওলজি গৃহশিক্ষককেও প্রতারণার জালে ফাঁসিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। গড়িয়ার দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে কর্মরত ওই শিক্ষক পড়ানোর পাশাপাশি অভিনয় করতেন। বাড়ি সোনারপুরে। অভিযোগ, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিনেমায় অভিনয়ের টোপ দিয়ে শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নেন। কখনও আর্টিস্ট ফোরামের কার্ড করিয়ে দেওয়ার নামে আবার কখনও শর্ট-ফিল্মে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন দেবাঞ্জনের সেই মাস্টারমশাই।

অভিযোগ ৯: জাল ভ্যাকসিন দিয়েছিলেন বাবাকেও

বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নিজের ভুয়ো ভ্যাকসিন ক্যাম্পে বাবা মনোরঞ্জন দেবকেও নিয়ে যান দেবাঞ্জন। মাকেও ভ্যাকসিন দিতে চেয়েছিলেন সেখানেই। কিন্তু তিনি শিবির থেকে নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নেবেন। পরে তদন্তে জানা যায়, বোনের এক বান্ধবী ও তাঁর পরিবারকেও ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন দেবাঞ্জন।

জেরার মুখে সে জানান, গত বছর সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে লোক নিয়োগ করা শুরু করেছিল সে। আর এই কাজের জন্য অশোক রায়কে প্রতি মাসে ৬৫ হাজার টাকা করে দিতেন।

আপনার কি চুল ঝরে মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে! যেনে নিন কিছু ঘরোয়া টোটকা

পুলিশ সূত্রে খবর, দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ না থাকায় গতবারে তার বিরুদ্ধে ওঠা প্রতারণা মামলায় ছাড় পেয়ে গিয়েছিল সে। এদিকে নিজের পরিবারকেও রেয়াত করেনি দেবাঞ্জন দেব! ঠকিয়েছিল নিজের মামাকেও। এমনটাই অভিযোগ করেছেন তার মামা সন্দীপ মান্না। পেশায় আঁকার শিক্ষক তিনি। নিজেও আঁকেন। থাকেন ডায়মন্ডহারবারের গোপাল দাস পাড়ায়। ভাগ্নে IAS অফিসার। আর সেই কারণেই নিজের আঁকার প্রদর্শনীর জন্য যোগাযোগ করেছিলেন দেবাঞ্জনের সঙ্গে। মামাকে ফেরায়নি সে। ২০১৯ সালের জুন সালে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে দেয়। তবে এর জন্য বেশ কিছু টাকাও দাবি করে বলে অভিযোগ করেছেন সন্দীপ।

কত টাকা চাওয়া হয়? তাঁর উত্তর, ‘কখনও ৩৫ হাজার, কখনও ৫৫ হাজার টাকার কথা বলেছিল। নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। গগনেন্দ্র প্রদর্শনশালায় বিশাল টাকার ব্যাপার ছিল। আমি জানতাম না। আচমকা কলকাতা গিয়ে টাকার কথা শুনি। তখন বাধ্য হয়ে পরিবার পরিজন এবং স্ত্রীর কাছে সাহায্য চাইতে হয়’।

Copyright © 2025 NEWS24-BENGALI.COM | All Rights Reserved.

google-news